
মোঃ সিরাজুল হক রাজু স্টাফ রিপোর্টার।
দীর্ঘ ১৩ বছর পর বরিশালের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘিতে পাখা মেলেছে অতিথি পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উছেঠে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা এই দিঘি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিকে প্রাকৃতিক আলপনা দিয়ে সাজানোর কাজ যতই এগিয়ে চলছে ততই পর্যটক ও দর্শনার্থীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর এই পাখি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রায় ২৪০ বছরের পুরনো দিঘিটি দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে। যদিও গত এক যুগেরও বেশি সময় এমন চিত্র দেখেনি স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিবনারায়নের খনন করা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘিতে শীতের সময় আসা বিদেশি পাখিদের অবাধ বিচরণে সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করতো। তবে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে এখানকার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। স্থানীয়দের মতে সিডরের সময় ত্রাণ নিয়ে হেলিকপ্টার আসার কারণে ভয়ে চলে গেছে দিঘির অতিথি পাখিরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অপরিকল্পিতভাবে মেহেগনিসহ বেশকিছু গাছ লাগানোতে পাখির বিচরণ কমেছে দিঘিটিতে। তাদের মতে মেহেগনিসহ ওইসব গাছ এমন ধরনের যে তাদের নিচে বা কাছাকাছি অন্য কোনো গাছ তেমন একটা হয় না। এমনকি মেহেগনির ফলও পাখিরা খেতেও চায় না। আবার কেউ কেউ বলছেন, প্রাকৃতিক কারণে তাপমাত্রার পরিবর্তন ও খাদ্য সংকটের কারণেই দুর্গাসাগরে গত কয়েক বছরে পরিযায়ীদের দেখা মেলেনি, বিশেষ করে শীতকালে ভিনদেশি পাখির অস্তিত্বও দেখা যায়নি। আবার দুর্গাসাগরের পাশের আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে চলাচলরত যানবাহনের শব্দ এবং চোরাগুপ্তা শিকারকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। যদিও এক যুগ পরে দেশীয়ও প্রজাতির পাশাপাশি শীতকালীন অতিথি পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত দুর্গাসাগর দেখে অনেকই হতবাক হচ্ছেন। চারিদিকে সবুজে ঘেরা এ দিঘি দেখতে আসা দর্শনার্থীরা মুগ্ধ। তারা দিঘিকে আরও পাখি বান্ধব করার দাবি জানিয়েছেন। আর অতিথি পাখির স্থায়ী বিচরণের জন্য দুর্গাসাগরে পাখি বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন ও পরিকল্পনার অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া দুর্গাসাগর দিঘিকে কয়েক বছর পরে সতেজ করার উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। এর ধারাবাহিকতায় বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান ও প্রাণিবান্ধবভাবে দিঘির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর প্রতি জোড় দেন। দিঘির পাড়ের গাছে মাটির হাড়ি বসানোসহ পাখি বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করেন। নতুন করে দিঘির পাড়ে ফলজ গাছ রোপন, দিঘির দক্ষিণ পাশে পদ্ম আর শাপলা ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দিঘিতে পুঁটি, মহাশোলসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের প্রচুর পরিমাণে মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। আর পাখিদের আকৃষ্ট করার জন্য দিঘিকে ঘিরে শত শত হাঁস ও কবুতর পালনও শুরু করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরই প্রথম দুর্গাসাগর দিঘিতে পরিযায়ীদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ পর্যটকরা। তারা জানান, দিঘির যেখানে শুধু পরিষ্কার পানি সেখানে পাখির দেখা মিলবে না। তবে দিঘির যে অংশে পদ্ম ও শাপলা রয়েছে, সেখানে প্রচুর পাখি থাকছে। পদ্ম আর শাপলার মধ্যে বসে চোখের আড়াল হয়ে যায় পাখিগুলো। হঠাৎ করে কেউ গেলে বুঝতে পাবে না, যে সেখানে পাখি রয়েছে। তবে যখন সেখান থেকে একঝাক পাঁখি উড়তে শুরু করে তখন মুগ্ধ-বিমোহিত হন দর্শনার্থীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা সুজন জানান, মূলত পদ্ম ও শাপলা খাবারের সন্ধান দিচ্ছে পাখিদের। সেজন্য অতিথি পাখিরা দিঘির ওই অংশে থাকছে। বর্তমানে দুর্গাসাগরের পরিবেশ যেভাবে নিরাপদ করা হয়েছে, সেভাবে থাকলে পরিযায়ীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবে এবং শীতের সময় প্রতি বছরই তারা আসবে। আর পরিবেশের উন্নতি ঘটায় এখানে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখির বিচরণও এখানে বেড়েছে। পাখি থাকলে পর্যটকরা আগের মতো দুর্গাসাগরের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। আর কৃষি নির্ভর এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের নতুন উন্নয়ন ঘটবে পর্যটন বিকাশের মধ্য দিয়ে। পর্যটক কামরুজ্জামান রেজা জানান, বরিশালে ঘুরে বেড়ানোর মতো তেমন কোনো জায়গা নেই, তবে দুর্গাসাগর একটি ঐতিহ্যের প্রতীক। সিডরের পর পরিবার নিয়ে সেখানে ঘুরতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিশেষ করে স্থানীয় বখাটেদের উৎপাত এবং বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায়ও ভোগান্তি বাড়িয়েছে। তবে এখন পরিবেশ অনেক সুন্দর হয়েছে। সিসি ক্যামেরা দিঘির পরিবেশকে নিরাপদ করেছে। সেই সঙ্গে গোটা দিঘি ঘিরে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া দিঘিতে বোট, তীরে ছাতা, টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা পর্যটক বান্ধব সিদ্ধান্ত। আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফেরার পাশাপাশি পাখির বিচরণও বেড়েছে। যা ধরে রাখা উচিত। তবে চলাচলের অভ্যন্তরীন রাস্তায় কিছুটা সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব দিকের রাস্তার বেশ কিছু অংশ ভাঙ্গা এবং জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এগুলো পরিস্কার করলে দূর্গাসাগর দিঘিতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা শঙ্কাহীন চিত্তে আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।
এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, একযুগ পর ফিরে আসা পাখির অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রচুর পরিমানের শামুক ছাড়া হয়েছে এই দিঘিতে। পাশাপাশি কুমিল্লা ও যশোর থেকে লাল, সাদা ও নীল পদ্ম এনে এই দিঘিতে লাগানো হয়েছে। একইভাবে সাদা, লাল ও নীল শাপলা লাগানো হয়েছে। এছাড়া দিঘির যে প্রান্তে পাখি বেশি বিচরণ করে সেখানে মানুষের যাতায়াত কমিয়ে দেয়া হয়েছে। গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হাড়ি। যাতে করে শুধু বিদেশী পাখিই নয়, নানা প্রজাতির দেশী পাখিও এখানে আসতে পারে